শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৯ পূর্বাহ্ন
ইশরাত জাহান দিলরুবা:
সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় মানুষ যা করে তা-ই তার সংস্কৃতি। মানুষ যা করে, যা পড়ে, যা ভোগ করে, যা উপভোগ করে তা-ই তার সংস্কৃতি। একেক সমাজের একেক রীতি, তাই সংস্কৃতিও ভিন্ন ভিন্ন। দেশ ভিন্ন হলে সংস্কৃতিও ভিন্ন হয়ে যায়।
বিশ্বায়নের এই যুগে সংস্কৃতির আন্তর্জাতিকায়নও হয়েছে। তাই মানুষ যেকোনও দেশের সংস্কৃতি সহজেই রপ্ত করে তৃপ্ত হয়। অজানাকে জানার আগ্রহ মানুষের চিরায়ত স্বভাব। তাই এক সমাজের মানুষ আরেক সমাজে আগ্রহী হয়। বেশিরভাগ মানুষ উন্নত দেশ ও উন্নত জাতির পোশাক, খাবার রপ্ত করে তৃপ্ত হয়। এমনকি তাদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানও অনুসরণ করে। উচ্চ আয় কিংবা নিম্ন আয়ের সব আর্থসামাজিক শ্রেণির মানুষই একই পথে হাঁটতে থাকে।
পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্য কিছু যদি অনুসরণ করি, তবে তাদের কাজের সংস্কৃতি কেন নয়?
ড. বিনায়ক সেনের ‘সাইজ অ্যান্ড গ্রোথ অব দ্য মিডল ক্লাস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিখ্যাত গবেষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ হবে মধ্যবিত্ত। নিম্নবিত্তদের বড় অংশই কোনও না কোনও কাজ করবে, আবার উচ্চবিত্তরাও কিছু না কিছু করবে।
তবে বাস্তবতা হলো মধ্যবিত্তের মধ্যেই বেকারত্বের সংখ্যা বেশি। এই শিক্ষিত এবং দায়িত্বশীল মধ্যবিত্তকে যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি আরও দ্রুত ও টেকসই হবে। তবে এজন্য সমাজের মানুষের ধারণাটা বদলাতে হবে। কীভাবে? লোক দেখানো অনেক কিছু বাদ দিতে হবে। একটা উদাহরণ দিলেই সবাই বুঝতে পারবেন। শীলা একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তার স্বামী একটা কলেজে পড়ায়। শীলার মেয়ে হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দেন। সে ঘরের কাজ আর মেয়েকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু একটা চিন্তা তার মাথার মধ্যে সবসময়ই ঘুরপাক খেতে থাকে, তার সারা জীবনের শিক্ষার সনদগুলো কি কাজে লাগবে? সেগুলো কেন এত যত্নে আলমারিতে তুলে রেখেছে? সে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করেই একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন। কিন্তু এগুলো তো কোনও উপকারেই লাগছে না; বরং যারা লেখাপড়া না করে আগেভাগে বিয়ে করেছে, তারাই তো ভালো গুছিয়ে সংসার করতে পারছেন। এই চিন্তা করতে করতে শীলার চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে। এতদিন পরে সে আর ভালো চাকরিও পাবে না। তাহলে শীলা কি এখন গৃহিণী হয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন? হয়তো এটা বাংলাদেশে খুব সাধারণ এক ঘটনা। যদি আমেরিকা হতো, শীলা কি ঘরের কাজ করেই জীবন কাটাতো? মোটেই না। যে ভূমিতে জন্ম আমার-আপনার, সেটি ছেড়ে বিদেশ যেতে কারোরই মন চায় না। তবু দেশের মায়া ত্যাগ করে মানুষ বিদেশ যায়। কত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে নিজের জীবনটা উন্নত করেন তারা।
আমাদের দেশে যদি সে ওই কাজ করতো, সমাজে কেউ তাকে বিদেশ ফেরতের মতো সম্মান করতো না। কিন্তু কেন? সম্মান করতে সমস্যা কোথায়? নিজেদের নিজেরা সম্মান করে, নিজেকে এগিয়ে নিয়ে, দেশকে এগিয়ে নেওয়া কোনও অসম্মানের বিষয় নয়।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ বিদেশে যাওয়ায় জন্য মরিয়া। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা এসব পশ্চিমা দেশ হলে তো কথাই নেই, দুই পায়ে খাড়া। এ দেশের অনেকের আত্মীয়-স্বজন সেসব দেশে আছেন। একটু খবর নিলেই জানবেন অনেকে সেসব দেশে গিয়ে কী করেন? কেউ গাড়ি চালান, কেউ রেস্টুরেন্টে কাজ করেন, কেউ শপিং মলে বা ফুটপাতে বসে ব্যবসা করেন। আমাদের দেশে ক’জন শিক্ষিত মানুষ এসব করেন? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা ছাড়া অনেক পরিবার তো মেয়েকে বিয়েও দিতে চান না।
নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে গার্মেন্ট সেক্টরের বদৌলতে। তাছাড়াও নিম্নবিত্ত যারা তারা পরিবারের সবাই মিলে কাজ করেন। পরিবারের বাবা হয়তো রিকশা চালায়, মা মানুষের বাসায় কাজ করেন, সাত-আট বছরের ছেলে টেম্পো, দোকান বা হোটেলের সাহায্যকারী– মোটকথা সবাই কিছু না কিছু করে। এছাড়া কোনও কিছুর প্রয়োজনে, যেমন- কেউ অসুস্থ, মেয়ের বিয়ে প্রসঙ্গ এলেই অন্যের কাছে হাত পাততে পারেন।
মধ্য আয়ের মানুষ না পারছেন ঢোক গিলতে, না পারছেন ঢোক ফেলতে। হয়তো কোনও পরিবারে দুজন সন্তান, স্ত্রী, মা-বাবা সবাই একজনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। স্ত্রী হয়তো শিক্ষিত কিন্তু সংসার দেখাশোনা করতে গিয়ে আর কিছু করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু টানাটানির সংসার চালাতে গিয়ে নিজের শখ আহ্লাদ সব ভুলে গেছেন। বিয়ের আগে কি টিপটপ থাকতো! চোখে মাসকারা আর কাজল ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু এখন চোখে আর কাজল লাগাতে হয় না, এমনিতেই চোখের নিচে কালি পড়ে কাজলের মতো লেপ্টে থাকে। কীভাবে চলবে সংসার নামক যন্ত্রটি। নিয়মিত তেল না দিলে যে মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে। মধ্যবিত্তের জীবন বড়ই কষ্টকর। মাথা থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত কষ্ট স্পর্শ করে যায়।
আমরা যদি পশ্চিমাদের মতো, সবাই বাইরে কাজ করবো–এই সংস্কৃতি অনুসরণ করতাম, তাহলে কি মধ্যবিত্তের এত কষ্ট হতো? গৃহিণীরা তখন বাসার সব কাজ সেরে যেকোনও একটা শিফটে আট ঘণ্টা কাজ করে কর্মঘণ্টা অনুযায়ী কিছুটা ইনকাম করতে পারতো। তাতে জীবনটা কত সহজ হতো! ইচ্ছে না করলে কিছু দিন বিরতি নিয়ে আবার কাজ করতে পারতো। যেকোনও ছোট কাজ হলেও করতে পারতো। কিন্তু আমাদের দেশে ছোট কাজ করলে মান-সম্মান খোয়া যায়। কারণ, সমাজের ভয়। মানুষ কী বলবে? চোখেমুখে চিন্তা, রাত জেগে জেগে চিন্তা করতে করতে অসুখ বাধিয়ে ফেলে। চিকিৎসার টাকা নেই কিন্তু সম্মান সে তো আছে, কেউ জানলো না যে আমি ভালো নেই। এতেই বেশ খুশি।
আসলে এভাবে হয় না? কেন বাঙালি পারবে না, অবশ্যই পারবে। কারণ, তারা বিদেশে গিয়ে তো ঠিকই পারেন। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হলো পরিবেশ, নোংরা পরিবেশ, নোংরা কথা। দেশ উন্নতির দিকে গেলেও মানুষ, মানুষের মন উন্নত হয়নি।
লেখক: সমাজ গবেষক
ভয়েস/জেইউ।